আমি কিছুদিন আগে মায়ের কাছ থেকে একটা মেসেজ পেয়েছিলাম। লেখা ছিল ‘ কল মি’। মা এভাবেই আমাকে মেসেজগুলো পাঠায়। মা’কে ফেসবুকে একাউন্ট ওপেন করে দিয়েছিলাম আমি নিজে। তখন বুঝিনি মা ফেসবুকে এতটা সড়গড় হয়ে উঠবে। আসলে আমার মা আমাকে নিয়ে সব সময় টেনশানে থাকে। একটা মাত্র মেয়ে হওয়ার এই এক বিপদ। সারাটাক্ষণ ‘হারাই হারাই’ ভাব করতে থাকে। গত বছর আমি দেশে গিয়েছিলাম। সাথে নিয়েছিলাম আমার পুরানো ল্যাপটপ, মায়ের জন্য। যদিও দেশ থেকে আমেরিকাতে ফোন করতে খুব বেশী খরচ হয়না, তবে দিনে চারবার ফোন করলে অনেকটাই খরচ হয়। মা আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলনা। সেইজন্যই ল্যাপটপটা নিয়ে গেছিলাম। ইন্টারনেট কার্ড কিনে দিয়ে সব কিছু শিখিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মা’কে দেখতে খুব সাদাসিধে মনে হলেও মা আমার খুবই বুদ্ধিমতী। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে জানে। ফেসবুক ওপেন করে দিয়ে কিভাবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে হয় সেটা দেখাতে গিয়ে আমার খুব ঘনিষ্ঠ কয়েক বন্ধুর সাথে ফ্রেন্ডশীপ করে দিয়েছিলাম। এক বছর হয়েছে মা ফেসবুক ব্যবহার করেন। এক বছরে ফ্রেন্ড এর সংখ্যা ১৪ থেকে বেড়ে গিয়ে ৩১৭ তে দাঁড়িয়েছে। মায়ের বন্ধু তালিকাতে কত নামী দামী লোকের নাম দেখি। আপডেট দেখে অবাক হই, সকলের সাথে মা কমেন্ট বিনিময় করে চলেছে। প্রতিদিন একটা করে স্ট্যাটাস দেয়। মা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে স্ট্যাটাস চেঞ্জ করার সাথে সাথে ‘লাইক’ পড়তে থাকে। আমাকে প্রথমদিকে অনেক লম্বা লম্বা মেসেজ লিখে পাঠাত, ইদা্নীং মনে হয় এত কথা লিখার সময় পায়না। বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং এর একফাঁকে আমাকে দুই শব্দে মেসেজ লিখে দেয়।
আজকে ক্লাসে যাওয়ার আগে মা’কে ফোন করেছি। ফোনটা মা ধরেছে। তবে ফোনটা ধরে অন্য দিনের মত তড়বড় করলোনা, খুব আস্তে করে বললো,
“মাধুর্য্য, তোর শরীর ভালো তো! তিনদিন লাগলো কেন আমাকে ফোন করতে”?
বললাম, “ রিসার্চের কাজে ল্যাবেই কেটেছে সারাবেলা। আজকে একটু দেরীতে যাব তাই ফোনটা করলাম। আমি ভালো আছি। কল করতে বলেছো কেন”?
মা কিছুটা সময় চুপ করে থাকলেন। তারপর খুব আস্তে আস্তে বললেন, “ আমার সেজো মেসোর শরীর খুব খারাপ। ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ। ডাক্তার ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে”।
এবার আমার থমকানোর পালা। মায়ের সেজ মেসো অর্থাৎ আমার দাদুর ক্যান্সার, তাও কিনা লাস্ট স্টেজ!! জিজ্ঞেস করলাম, “ ক্যান্সারতো বুঝলাম, কিনতু কোথায় বাসা বাঁধলো এই ব্যাধি”!
মা বললেন, “ খাদ্যনালী আর পাকস্থলীর সংযোগস্থলে টিউমার ধরা পড়েছে। বায়োপসী করেই জানা গেছে, লাস্ট স্টেজ অবস্থার কথা। মাসী খুব ভেঙ্গে পড়েছে। কেমো দেওয়া শুরু করেছিল, কিনতু মেসোর শরীর এত বেশী দূর্বল যে কেমো শুরু করেই বন্ধ করে দিতে হয়েছে”।
বললাম, “ মা আমার খুব খারাপ লাগছে খবরটা শুনে। এই দাদু তোমাকে কি পরিমান ভাল যে বাসেন! দাদুরও ক্যান্সার হয়ে গেল! তোমাকে ভালোবাসার একজন কমে যাবে”!
মা বললো, “ মাধুর্য্য, এখন আসল কথায় আসি। আমি কলকাতা যেতে চাই। একা একা যেতে পারবোনা। তোর বাবাও যাবেনা বলেছে। তুই কি আসতে পারবি সামনের মাসে”?
আমি কি বলবো ভেবে পেলামনা। তবুও বললাম, “ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো ছুটি নিতে। তুমি কিছু ভেবোনা। তুমি ভালো থেকো, আজকে রাখছি”।
ফোন ছেড়ে দিলাম। এরপরেই ডিপার্টমেন্টে গিয়ে এডভাইজারের সাথে দেখা করে সবকিছু জানিয়ে এক মাসের জন্য ছুটি মঞ্জুর করিয়ে বাড়ী ফিরলাম। মাসীদিদাকেও ফোন করলাম দাদুর শারিরীক অবস্থার খোঁজ নিতে। উত্তর খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিলনা। ইদানিং উনি অনেককেই চিনতে পারেননা। তবে আমার মা’কে দেখতে চাইছেন। বারবার মায়ের কথা বলছেন। আমার মা’কে তাদের ফ্যামিলির প্রতিটি মানুষ ভালোবাসে। সেইজন্যই মা এতটা অস্থির হয়ে আছে। আমার বাবাও ভালো মানুষ কিনতু আমার মায়ের মত অতটা সংবেদনশীল নন।
শাহীন ভাইকে ফোন করলাম। টিকিট বুকিং করতে হবে। এর আগেরবার এমিরেটস এয়ারওয়েজে চড়েছিলাম, এবার কাতার এয়ারলাইনস এ টিকিট কাটলাম। জুনের ৫ তারিখ যাওয়ার ডেট। মা’কে ফোন করে বলে দিলাম যেনো ঢাকা থেকেই কলকাতার দুটো এয়ার টিকেট কিনে ফেলে। আমার এই দাদুর ভালোবাসার একটা নমুনা বলি। আমার বয়স যখন তিন বছর, আমি মা বাবার সাথে কলকাতা গেছিলাম। কলকাতা গেলে আমরা মায়ের এই সেজ মাসীর বাড়িতে গিয়েই উঠি। সেবারেও উঠেছিলাম। আমার শরীর এত বেশী খারাপ ছিল যে আমাদের শান্তি নিকেতন যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করতে হয়েছিল। আমার হজমের খুব সমস্যা ছিল। ডাক্তারী সকল চিকিৎসা ফেল করেছে, আমার অসুখ সারেনি। পরে কবিরাজী চিকিৎসা শুরু হতেই একটু ভালোর দিকে যাচ্ছিলাম। ডাক্তার পথ্য হিসেবে কাঁচা বেলের শরবত খেতে দিয়েছিল। বেড়াতে বের হয়ে কি আর কাঁচা বেলের বস্তা নিয়ে ঘুরা যায়! বেলের সিজন ছিলনা, তবে দাদু চারটি বেল কোথা থেকে যোগাড় করে ফেলেছিল কে জানে! সেই বেল খাওয়ার পর কিনতু আমার শরীর ভালো হয়ে গেছিল। আমি নিমপাতা ভাজা খেতে ভালোবাসতাম বলে দাদু নিজে হাতে উনার বাড়ীর বাগানে একটি নিমগাছ লাগিয়েছিলেন। গাছের নাম রেখেছেন ‘মাধুর্য্য’। যে দুই দিন ছিলাম দাদু আমাকে কোলে কোলে রেখেছেন। এগুলো আমার মনে আছে স্পষ্ট। সেই দাদু মারা যাবেন আর মাত্র ছয় মাস পরেই! ৫ তারিখে প্লেনে চেপে বসলাম। দেড় দিন লেগেছে ঢাকা আসতে। ঢাকা এসেই জানতে পেলাম কলকাতা যাওয়ার জন্য টিকেট কাটা হয়ে গেছে।
দুই
মা’কে নিয়ে জেট এয়ারওয়েজে করে কলকাতা চলে গেলাম। কলকাতায় মাসী দিদার বাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। দাদুকে প্রথম দেখেই মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলো। দাদু বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের দেখার জন্যই বসে আছেন। দাদু দেখতে একেবারে কংকালের মত হয়ে গেছে। সারা শরীরের চামড়াও পুড়ে গেছে। কিনতু চোখ জোড়া এখনও ঝলমল করে। চোখ দেখে মনেই হয়না মানুষটার ভেতরে এত বড় ভয়ংকর রোগ বাসা বেঁধেছে। আমাদেরকে দেখার সাথে সাথে আমার দিদাকে ডাকছিল, “ কই গো, আমার বড় মেয়েটাকে কিছু খেতে দাও। নাতনী কি খাবে কিছু কি ঠিক করেছ!” বলে পাড়ার মানুষ জাগিয়ে তোলার উপক্রম করে ফেলেছিল। আমি আর মা এই বাড়ীতে কতবার যে এসেছি তার ইয়ত্বা নেই। কিনতু দাদু মনে করতে পারছেনা। বার বার ভাবছে আমরা প্রথমবার বুঝি এসেছি। বাড়ীটা দাদুর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বানানো। বাড়ীর বাগানে যত গাছ, সব দাদুর হাতে বড় হয়েছে। দিদা বললো যে দাদু নাকি চারিদিকে তাকিয়ে দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
মেসোদাদু একা একা খুব কাঁদে। এখন উনার ভোগ করার সময়। সারাজীবন খুব কষ্ট করেছিলেন। দাদুর মেয়ের খুব ভালো বিয়ে হয়েছে। অনেক বিত্তশালী পরিবার। মেয়ের কাছে বেড়াতে গেছিল সাত আট মাস আগে, সেখানেই পেটে ব্যথা হচ্ছিল বলে ডাক্তার দেখানো হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষায় ক্যান্সার ধরা পড়ার সাথে সাথেই ওখানকার ডাক্তারেরা মেসো দাদুকে সব কিছু বলে দেয়। সেই থেকে প্রথম কিছুদিন দাদু নাকি কিছুই খাওয়া দাওয়া করেনি। বেশ কান্নাকাটি করেছে। এখন একেবারেই চুপ। খাওয়া দাওয়া বন্ধই বলতে গেলে। তরল খাবার খাওয়ানো হয়। ফলে দাদু খেতে চাননা। আমার এই মেসোদাদু খুব ভোজন বিলাসী ছিল। আমার দিদাকে প্রতিদিন ডেকে বলতো কোনটা দিয়ে কোনটা রাঁধতে হবে। দাদু আর খেতে পারেনা বলে আমার দিদা কিছুই রাঁধেননা।
আজকেই দিদা কচুর লতি রান্না করছিলেন দেখে দাদু বললো, “ শুধু লতি খাওয়াবে, তেলপটল খাওয়াবেনা’? দাদু এগুলো যত বেশী বলে মা তত বেশী কষ্ট পায়। আড়চোখে দাদুর দিকে তাকাতেই দেখলাম চেয়ারে বসে কি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কচুর লতির দিকে। কচুর লতি, কুমড়ো ডাটা খুব ভালোবাসতেন। মানুষটির দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগলো। কিনতু কিছুতো করার নেই। দাদুকে ছোট্ট করে ডাক দিতেই দাদু আমার দিকে তাকালো। ঢিলে চশমার ফাঁক থেকে দাদুর সেই সুন্দর চোখ কি আদুরে ভঙ্গীতে তাকাচ্ছে আমার দিকে। চোখদুটো খুব সুন্দর। দাদুর ছেলেমেয়েরা বাবার চোখের ধরন পেয়েছে। দাদু হঠাৎ করেই বললো, “ মাধুর্য্য, তোমার বিয়ে পর্যন্ত বাঁচলে হয়! নিজে চোখে দেখতে ইচ্ছে করে। তবে খুব কষ্ট পাচ্ছি, খেতে ইচ্ছে করে, কিছুই খেতে পারিনা। জানিনা আদৌ তোমার বিয়ে দেখতে পারবো কিনা”। অসংলগ্ন কথা বলছে দাদু, আমার বিয়ে অনেক দেরী আছে, অথচ এমনভাবে বলছে যেনো বিয়ের ডেট হয়ে গেছে। দাদুর দিকে চোখ তুলে চাইলাম, সেই একই হাসি, কালো গভীর চোখ, যে চোখের দিকে তাকালে মনটা খুশীতে ভরে উঠে।
গতকাল দেশে চলে এসেছি। আমরা ওখান থেকে রওনা দেয়ার দশ মিনিট আগে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। মেসোদাদু আর মেসোদিদাকে একসাথে করে। অন্য সময় মেসোদাদু এই ছবি তুলত কিনা জানিনা তবে গতকাল খুব মজা করেই ছবি তুললো। একবার দূর্বল হাতে মাসীদিদার কোমর জড়িয়ে ধরে পোজ দিয়েই ছবি তুললো। কে জানে হয়তো উনার যৌবন বয়সের স্মৃতি উড়ে এসেছে মনে। একবার মা’কে বলে ফেললেন, “ আমার মত এমন ভাগ্য কজনের হয়! এই মানুষটিকে সঙ্গী করে সংসার সমুদ্রে নামলাম, আজ অবধী তোমার মাসী আমাকে মাথায় করে রেখেছে। আমার মৃত্যুর পর তুমি তাকে দেখে রেখো। এই কথাটা তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। তুমি আমার বড় মেয়ে। তোমাকে বলতে পেরেছি, আমি খুশী’। এরপরে আমাকে ডাকলেন কাছে, বললেন “ মাধুর্য্য, তোমার নামের সাথে কাজে কত মিল। কি দারুন সব ছবি তুলে ফেললে। আমি কি ছবিগুলো দেখতে পাব? যখন ছবিগুলো ছাপবে তুমি সুন্দর করে এডিট করে দিও। আমাকে যেনো খুব বেশী খারাপ দেখা না যায়। তোমার দিদুর সাথে আমার অনেক ছবি আছে। তুমি পরে দেখে নিও সেগুলো। খুব বেশী করে মনে পরে যাচ্ছে সেসব দিনের কথা”!
আমি আজকেই ক্যামেরা থেকে ছবিগুলো কম্পিউটারে ট্র্যান্সফার করছিলাম। সৌমিক মামার কাছে মেইল করে দেবো। মামা পরে দাদুকে দেখাবে। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। দাদু অনেক চেষ্টা করে মুখে হাসি ধরে রেখেছে। শুকিয়ে যাওয়া মুখে চশমাটা কেমন ঢলঢল করছে। কিনতু চোখগুলো হাসছে। দিদাকে কোমড়ে জড়িয়ে ধরা ছবিটা দারুন এসেছে। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি খুব খুশী হবে ছবিটা দেখলে। ছবিটা হাতে নিয়ে উনার সোনালী দিনের কথা মনে পড়বে, হলুদ হয়ে যাওয়া জীবনে এক টুকরো সবুজের ছোঁয়া এনে দিয়েছে ছবিটি। ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে একটু আদর করে দিলাম। এই ক্যামেরার লেন্সে ধরা থাকলো এক রোমান্টিক দূর্ভাগা দম্পতির শেষ মধুময় স্মৃতি।
১৯ জানুয়ারী - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৬৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী